Wellcome to National Portal
মেনু নির্বাচন করুন
Main Comtent Skiped

গ্রাম আদালতের কার্যক্রম
সামাজিক সুবিচার এবং গ্রাম-আদালতহতদরিদ্র গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কাছে স্বল্প খরচে ন্যায়বিচারের সুফল পৌঁছে দিতে 'গ্রাম-আদালতের' প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করা হয়েছিল সেই ১৯৭৬ সালেই। অকার্যকর এই ব্যবস্থাটিতে গতি আনতে সংশ্লিষ্ট আইনে পরিবর্তন আনা হয়েছে ২০০৬ সালে। তারপরও গ্রাম-আদালত কাঙ্ক্ষিত সুফল দিতে পারছে না। গ্রাম-আদালত সম্পর্কে মানুষের অজ্ঞতা এবং আদালতে দায়িত্বরত বিচারকদের দক্ষতার অভাবের কারণে গ্রাম আদালত এখনো তেমন একটা কার্যকর নয়। এ নিয়েই লিখেছেন উমর ফাঈলাসূফএ ধরনের ফতোয়াভিত্তিক সালিশি বিচার ঠেকাতে গ্রাম আদালত ভূমিকা রাখতে পারেস্বাধীনতার অব্যবহিত পরে যখন আমাদের দেশের আইন ও বিচার ব্যবস্থা শৈশবকাল পার করছে তখন থেকেই আইন প্রণেতারা অনুধাবন করতে শুরু করেন যে, দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে ন্যায়বিচার পৌঁছে দিতে হলে শুধু প্রচলিত দেওয়ানি আর ফৌজদারি আদালতগুলোই যথেষ্ট নয়, বরং এর সঙ্গে এমন একটি বিচারকাঠামো দরকার- যার মাধ্যমে স্বল্প সময় আর অর্থ ব্যয় করে ছোটো-খাটো বিবাদের মীমাংসা করা সম্ভব। এই ধারণাকে বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে ১৯৭৬ সালে প্রণীত হয় 'গ্রাম আদালত অধ্যাদেশ, ১৯৭৬'। এর মাধ্যমে গ্রামে বহু আগ থেকে প্রচলিত 'সালিশ ব্যবস্থা'কে ঢেলে সাজিয়ে একটি স্বতন্ত্র বিচার কাঠামোতে রূপদান করা হয়। পরবর্তীতে সামান্য কিছু সংশোধনের পর ২০০৬ সালে এই অধ্যাদেশটিকে আইনে রূপান্তরিত করা হয়, 'গ্রাম আদালত আইন' নামে। ইউনিয়ন পর্যায়ের এই আদালত জজ আদালতগুলোতে মামলার চাপ কমাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। ফলে বিচারব্যবস্থাতেও গতিশীলতা আসছে। আইন অনুযায়ী পাঁচজন সদস্য নিয়ে গঠিত গ্রাম-আদালত একটি পূর্ণাঙ্গ আদালত। বাদী ও বিবাদী উভয় পক্ষ থেকে একজন করে স্থানীয় মুরুবি্ব এবং একজন করে ইউপি সদস্য এবং সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যানকে নিয়ে এই আদালত গঠিত হয়। আদালতের নিরপেক্ষতা নিয়ে যদি কোনো পক্ষের সংশয় বা অনাস্থা থাকে তাহলে যথাযথ কারণ দেখিয়ে চেয়ারম্যানের কাছে অথবা ইউএনও অফিসে আবেদন করা যাবে। এখানে কোনো পক্ষ থেকেই আইনজীবী নিয়োগের সুযোগ নেই। সর্বোচ্চ পঁচিশ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে এই আদালতকে। দেওয়ানি ও ফৌজদারির বিশেষ বিশেষ কিছু ধারার মামলা বিচারের এখতিয়ার দেয়া হয়েছে গ্রাম আদালতকে। ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে গ্রাম আদালতের এখতিয়ারভুক্ত ধারাগুলো হলো দ-বিধির ১৬০, ৩২৩, ৩৩৪, ৩৪১, ৩৪২, ৩৫২, ৩৫৮, ৪২৬, ৫০৪, ৫০৬ (প্রথম অংশ), ৫০৮, ৫০৯ এবং ৫১০ ধারা। এছাড়া ৩৭৯, ৩৮০, ৩৮১, ৪০৩, ৪০৬, ৪১৭, ৪২০, ৪২৭, ৪২৮, ৪২৯ (যদি ক্ষতির পরিমাণ অনধিক পঁচিশ হাজার টাকা হয়) এবং ১৪১, ১৪৩, ১৪৭ গবাদিপশু সম্পর্কিত (আসামি অনধিক দশ জন হলে)। দেওয়ানি মামলার ক্ষেত্রে- চুক্তি বা দলিলমূলে প্রাপ্য টাকা আদায়, কোনো অস্থাবর সম্পত্তি বিনষ্ট করা অথবা মূল্য আদায়, স্থাবর সম্পত্তির দখল পুনরুদ্ধার, গবাদি পশুর অনধিকার প্রবেশের জন্য ক্ষতিপূরণ এবং কৃষি শ্রমিকের মজুরি সংক্রান্ত মামলাসমূহের বিচার গ্রাম আদালতে করা সম্ভব। তবে শর্ত হচ্ছে, সেই স্থাবর বা অস্থাবর জমির মূল্যমান অবশ্যই পঁচিশ হাজার টাকার নিচে হতে হবে। বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মামলার বিচার গ্রাম-আদালতে হয় না। যেমন ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তি যদি পূর্বে অন্য কোনো আদালত কর্তৃক সাজাপ্রাপ্ত আসামি হয়। কিংবা দেওয়ানি মামলায় যদি অপ্রাপ্তবয়স্কের স্বার্থ জড়িত থাকে, দুই পক্ষের ভেতর আগে সালিশি চুক্তি হয়ে থাকলে, মামলাটিতে সরকার, স্থানীয় প্রশাসন বা কর্মরত সরকারি কর্মচারী পক্ষভুক্ত হলে। এসব ক্ষেত্রে অপরাধের বিচার প্রচলিত নিয়মে জজ আদালতে হবে। এছাড়া অপ্রকৃতিস্থ ব্যক্তির বিরুদ্ধেও কোনো অভিযোগ এই আদালত গ্রহণ করতে পারবে না। গ্রাম আদালতে বিচার পেতে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বরাবর দরখাস্ত লিখতে হয়। দেওয়ানি মামলার ক্ষেত্রে ৪ টাকা এবং ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে ২ টাকা ফি দিয়ে বিবদমান যে কোনো পক্ষ চেয়ারম্যানের কাছে আবেদন করতে পারে। সেই দরখাস্তে ইউনিয়ন পরিষদের নাম, আবেদনকারীর নাম ও পরিচয়, অভিযোগ এবং তার প্রার্থিত প্রতিকার সুনির্দিষ্টভাবে লিখতে হয়। দরখাস্ত পাওয়ার পর চেয়ারম্যান উপরে উলি্লখিত নিয়মে পাঁচজন সদস্যের আদালত গঠন করবেন। এরপর পক্ষদ্বয়ের শুনানি এবং অন্যান্য বিচার প্রক্রিয়া শেষে প্রকাশ্যে রায় প্রদান করা হবে। রায়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতার অনুপাত উল্লেখ করার বাধ্যবাধকতা আছে। গ্রাম আদালতে রায় ঘোষণার ত্রিশ দিনের মধ্যে যে কোনো পক্ষ, ফৌজদারি মামলা হলে প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট এবং দেওয়ানি মামলা হলে সহকারী জজ আদালতে আপিল করতে পারবেন। গ্রাম-আদালতের ধারণাটি অত্যন্ত চমৎকার হলেও আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত এই আদালতে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিরা খুব একটা শরণাপন্ন হচ্ছেন না। গ্রাম-আদালত সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা না রাখা এবং বিচারিক কার্যক্রম ও আইন বিষয়ে এই আদালতের বিচারকদের জ্ঞানের স্বল্পতা গ্রাম-আদালতকে এখন পর্যন্ত কাঙ্ক্ষিত মানে উপনীত করতে পারে নি। সরকারি-বেসরকারিভাবে গ্রাম-আদালত সম্পর্কে গ্রামীণ অঞ্চলে তাই যথেষ্ট প্রচারণা চালালে এই আদালতের প্রতি মানুষের আস্থা আসতে পারে। অন্যদিকে গ্রাম-আদালতে বিচারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ ব্যক্তিদের যথাযথ আইনি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। নয়তো বিচারপ্রার্থীরা উল্টো রায় পেতে পারেন এবং আদালতের প্রতি তাদের অনীহা তৈরি হতে পারে। যদিও গ্রাম আদালতের কার্যক্রম এখনো আমাদের দেশে তুলনামূলকভাবে ধীরগতিতে প্রসারিত হচ্ছে, তারপরও যে আইনবলে একে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে তার পরিধি অত্যন্ত ব্যাপক এবং সুদূরপ্রসারী। তাই কম খরচে এবং কম সময়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে ন্যায় বিচার পৌঁছে দেয়ার যে মহান অভিপ্রায় নিয়ে এই আদালত গঠিত হয়েছে, তাতে অভীষ্ট হতে হলে অবশ্যই তৃণমূল পর্যায়ে গ্রাম আদালতের কার্যক্রমের প্রচার এবং এর ক্ষমতার সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।